দেশব্যাপী চলছে উপজেলা নির্বাচন বর্জন করেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত।
বাংলাদেশে নির্বাচন বর্জন আর প্রতিহত করার ইতিহাস নতুন নয়। অতীতেও ঘটেছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুই বৃহৎ দলের নির্বাচন বর্জন কার লাভ হচ্ছে, সেটা দেখার বিষয়। ১৯৭৯ সালের জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন আওয়ামীলীগ বর্জন করেনি। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনও বর্জন করেনি আওয়ামীলীগ। ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল আওয়ামীলীগ। সেই দু’টি নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কি হয়েছিল সেটা সকলের জানা। আর বিএনপি ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচন শুধু বর্জনই করেনি প্রতিহতও করেছিল। জনমনে ব্যাপক সাড়াও ফেলেছিল। দেশের অধিকাংশ এলাকা বিচ্ছিন্ন ছিল। সেই নির্বাচনের পরবর্তী সময় সম্পর্কেও জনগণের ধারণা রয়েছে। নির্বাচনের পরপরই হঠাৎ করে কর্মসূচি
শীথিল করে দেওয়া নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। তারা মেয়াদ শেষ করেছিল।শুধু তাই নয় ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল সকল দল। কিন্তু সে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এমনকি ক্ষমতাসীন দলও ভোট দিতে পারেনি। ভোটের নামে হয়েছে প্রহসন।২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করা হয়। তবে প্রতিহত করা হয়নি। কর্মসূচিটি ছিল শান্তিপূর্ণ। আহ্বান ছিল সকল গণতান্ত্রিক শক্তি যাতে ঘরে বসে থাকে। নিরব থাকে। ভোট কেন্দ্রে না যায়। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। জনগণ কেন্দ্রে যায়নি। সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক সেটা আওয়ামীলীগ চায়নি।যদি চাইত নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির ওপর এমন নির্যাতন চালাতো না সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করত না।নির্বাচনের পর বিএনপি জোট নীরব হয়ে যায়। হতাশা কাজ করে নেতাকর্মীদের মাঝে। যদিও নেতারা আত্মতৃপ্তি পায় ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় কিন্তু সেটির সুফল কি তা আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে ।
এখানে আরেকটি ইতিহাস মনে পড়ে। ২০০৮ সালে বিএনপি জামায়াতের ভরাডুবি হয়। নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবতারণা করতে চাই না। তবে সে নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি জামায়াত সমর্থিতরা। যদিও অনেক প্রার্থী আওয়ামীলীগের ব্যাপক বিজয়ের পর সরে পড়েন। তারপরও সেদিন বেগম খালেদা জিয়া উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে নির্বাচনে ভালো ফলাফলও আসে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনও বয়কট এবং প্রতিহত করে বিএনপি জামায়াত। সেই নির্বাচনের পরও বিএনপি জামায়াত উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সে নির্বাচনে বিপুল সফলতা পায় বিএনপি জামায়াত। চার ধাপে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে প্রথম ২ ধাপে বিএনপি জামায়াত ব্যাপকভাবে বিজয়ী হয়। নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি জামায়াত। পরবর্তীতে আবারও কয়েকটি উপ-নির্বাচনে অংশ নেন দলীয় প্রতীকে। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নেতাকর্মীরা স্থানীয়ভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
ধারণা করেছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা পরিবর্তনের দু’টি ধারা হতে পারে। একটি গণঅভ্যুত্থান, অপরটি নির্বাচন। এই মুহূর্তে এবং গত ১৫ বছরের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গণঅভ্যুত্থান সম্ভব নয়। তার কারণ হয়তো অন্য আলোচনায় বলা যাবে। অপরটি নির্বাচন। নির্বাচনে বিরোধী দল আসুক সেটি সরকার কোনোভাবেই চায় না। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বাবস্থা এটাই প্রমাণ করে। বিএনপি জামায়াত নির্বাচনে আসুক এটা সরকার মন থেকে চায়নি। তারও কারণ রয়েছে। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত আসুক এটাওকি আওয়ামী লীগ চায়? আমি বলি চায় না। কারণ জনগণ ভোটকেন্দ্রে আসলে সরকারি দলের অথবা তার সমর্থকদের অবস্থা কি হবে কিছুটা টের পেয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
বিএনপি জামায়াত ভোট বর্জনের ঘোষণায় আওয়ামী শিবিরে অনেকটা আনন্দই দেখেছি স্থানীয়ভাবে। তার কারণ একটাই ভয়ভীতি, শক্তি প্রদর্শন করে বিজয়ী হতে পারবে। বিএনপি’র এই নির্দেশনার পরও দুই ধাপে প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তাদের বহিস্কারও করা হয়। তাদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেয়া নেতার্কীদের হুশিয়ারি প্রদান করা হয়েছে।
বহিস্কৃত নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে স্থানীয় রাজনীতির আলোকেই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বহিস্কারকে তারা পরওয়া করছেন না। আরও দুই ধাপে হয়তো অনেক নেতা থাকবে প্রার্থী হিসেবে। তাদেরকেও বহিস্কার করা হবে। এতে করে দলের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। শুধু বহিস্কার নয় প্রার্থীদের বহিস্কার করাতে গ্রুপিং রাজনীতি কাজ করছে। নির্বাচনে যারা বিএনপি’র হয়ে কাজ করছেন তাদেরকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা বিএনপি’র অনেক নেতাই আওয়ামীলীগ প্রার্থীর পক্ষে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে কাজ করছে। তাদের ব্যাপারে বিএনপি অনেকটা নিরব। বিএনপি’র এই
বর্জনকে আওয়ামীলীগ কাজে লাগাচ্ছে। আওয়ামীলীগের অনেক এমপিরা বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। ভোটের মাঠে তাদের আনুকূল্য পেতে কাউকে ভোটের জন্য আবার কাউকে ভোট কেন্দ্রে না আসার জন্য অনুরোধ করছেন। অনেক স্থানে অনেক বিএনপি নেতা আওয়ামীলীগ প্রার্থীদের পক্ষে প্রকাশ্যে ভোটও চেয়েছেন। তাদের ব্যাপারে দল ব্যবস্থা নিচ্ছে না। জামায়াতের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচনের মাঠে কেউ না থাকলেও এলাকার বিভিন্ন মেরুকরণে অনেক নেতাই যোগাযোগ রাখছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া অন্য দলের প্রার্থীদের সঙ্গে। স্থানীয় সুযোগ সুবিধা, রাজনৈতিক হামলা, মামলা থেকে বাঁচতে এই কৌশল নিচ্ছে অনেক নেতারাই। স্থানীয় বিএনপি এবং জামায়াতের অনেক নেতার সাথেই আলাপ করে জানতে পেরেছি নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত বর্জন করায় লাভবান হচ্ছে আওয়ামীলীগের প্রার্থীরাই। তারা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই নির্বাচিত হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বিনা ভোটে নির্বাচিত হচ্ছে। দল অংশগ্রহণ না করায় দলের অনেক নেতাকর্মী কোনো না কোনো প্রার্থীর পক্ষে তৎপরতা চালাচ্ছে। দল যদি অংশগ্রহণ করতো তাহলে নেতাকর্মীরা অন্য দলের নেতাদের কাছে যেতেন না। অনেকে আওয়ামীলীগের দালালী করছৈ।নির্বাচন না করার ফলে নতুন প্রজন্মও দলে ভিড়ছেন না। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদেরকে উজ্জীবিত করা যেতো। নেতাকর্মীরা সংঘবদ্ধ হতো। হতাশা কাটতো। নতুন করে প্রাণ ফিরে পেতো। আওয়ামীলীগ দখল করে ভোট নিয়ে গেলেও জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস থাকতো।আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে গেলে বিজয়ী না হলেও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা যেত।
জাতীয় রাজনীতি আলাদা বিষয়। স্থানীয় রাজনীতিতে এলাকা, গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক পরিবেশ ভিন্নতা থাকে। সেটা স্থানীয়ভাবে ছেড়ে দিলেই ভালো হতো। বিএনপি’র অনেক নেতা বহিস্কার করা হয়েছে। এরা মাঠ পর্যায়ে কেউ বিচ্ছিন্ন নয়। এদের অবস্থান আছে। আওয়ামীলীগের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই ওরা নির্বাচনের মাঠে নেমেছিল। কত পরিশ্রমের বিনিময়ে একজন ভোটের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তা হয়তো কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন না। কিন্তু তাদেরকে বহিস্কার করা হলো। শুধু বহিস্কার নয় এদেরকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। তাহলে দলের কি লাভ হলো? দল ক্ষতিগ্রস্ত হলো.। সাধারণ মানুষের বক্তব্য বিএনপি জামাতের ক্ষতি হয়ে গেল। সুবিধা পাচ্ছে আওয়ামী লীগ।তার রেশ টানতে হবে দলকেই।