July 2, 2024

স্মার্টফোন ব্যবহার রাতে নিষিদ্ধ রাখা যেতে পারে

0
সংবাদ শেয়ার করুন

দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিকক্ষে স্মার্টফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর ওই নিষেধাজ্ঞা জারী করে। মাদ্রাসায়ও একই নিয়ম। পড়ুয়া- শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি মানা হচ্ছে। উত্তর, না। কড়াকড়ি নেই। তদারকির অভাব। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, নিষিদ্ধ করলে পড়ুয়াদের ফলাফল ভালো হয়। গতবছরের জুলাইয়ে স্কুলে স্মার্টফোনসহ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে বলেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো)। শ্রেণীকক্ষে মনোযোগের ব্যাঘাত রোধে, শিক্ষার মানোন্নয়নে এবং শিশুদের সাইবার বুলিং থেকে রক্ষা করতে এ আহ্বান জানানো হয়। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে এমন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০১৮ সালে ১৫ বছরের কম পড়ুয়াদের স্মার্টফোনসহ সব ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস স্কুলে নিষিদ্ধ করেছে ফ্রান্স। তার আগ থেকেই এমন নিয়ম চালু ছিল ফিলিপাইনে। গতবছর নেদারল্যান্ডস ও ফিনল্যান্ড নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এবছর নিষিদ্ধ হচ্ছে যুক্তরাজ্যে।

অপব্যবহার রোধে রাতে স্মার্টফোন ব্যবহার বন্ধ -সীমিত রাখার দাবী জানিয়েছেন কুমিল্লা-৭(চান্দিনা) আসনের এমপি ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্ত। শনিবার (২২ জুন) জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনায় তিনি এমন দাবী জানান। নতুন প্রজন্ম প্রতিবন্ধীতার শিকার হওয়ার আশংকা প্রকাশ করে কানের রোগীর সংখ্যা বাড়ার পেছনে স্মার্টফোনকে দায়ী করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও দেশখ্যাত নাক কাল গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ১০ বছর থেকে শুরু করে সবার একই সমস্যা- কানে শোঁ শোঁ করে, ভোঁ ভোঁ করে, কথা ঠিক মতো শুনি না, লেখা পড়ায় মন দিতে পারি না। তিনি বলেন, তাই এমন কোন অ্যাপস বা পদ্ধতি করা দরকার যাতে রাত ১০ টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত তরুণ প্রজন্ম এ প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকে। তবে ফ্রিল্যান্সিংসহ অন্যন্যদের বিকল্প সুবিধা রেখে। দেড় বছরের অধিককাল আগে রাত ১২ টার পর ইন্টারনেট বন্ধ রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন দেশের একজন মন্ত্রী।

স্মার্টফোন আসক্তি, সামাজিক ও শারীরিক প্রভাব নিয়ে দেশে- সমাজেও নানা পরিণতি ও আলোচনা রয়েছে।

মোবাইল বা টিভি দেখতে দেখতে বাচ্চা খায়। না হলে খেতে চায় না। সব মায়ের একই কথা। এতে বাচ্চা খাওয়ার স্বাদ বোঝে না, আনন্দ পায় না। শুধু কি এই ক্ষতিই হয়। না এর প্রভাব ও ক্ষতি অনেক ও সুদুরপ্রসারি। টিভি বন্ধ করে দিলাম তো ফোন দেখতে থাকে। ফোনটা নিয়ে নিলাম তো আবার টিভি। ওরা ফোন বা টিভি ছাড়া থাকতেই পারছে না। এ আসক্তি নিয়ে অভিভাবকদের হিমসিম খেতে হচ্ছে।

বাচ্চারা কোন বয়সে হাতে ডিজিটাল ডিভাইস আর কতক্ষণ স্ক্রিন টাইম পেতে পারে- এর একটি মানদণ্ড দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এক বছরের কম বয়সী বাচ্চার হাতে ডিভাইস যাওয়া একদমই উচিত নয়। দুই বছরের বাচ্চা একঘন্টার বেশি স্ক্রিন টাইম নয়, কম হলে আরও ভালো। তিন থেকে চার বয়সের বাচ্চা একঘন্টার বেশি যেন ডিভাইস ব্যবহার না করে।

অন্যমত হলো, ১৪ থেকে ১৬ বছরের অধিক বয়সে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করা, তবে সেটা যেন নেশা বা অতিরিক্ত পরিমাণে না হয়, হলে অপব্যবহার। এমনটাই বেশি। বয়সন্ধিকালে স্মার্টফোন ব্যবহারের গতি- প্রকৃতি লক্ষ্য রাখা উচিত। সমীক্ষা বলছে, দৈনিক ৩-৪ ঘন্টার বেশি স্মার্ট ডিভাইসে তাকিয়ে থাকলে ব্রেইনে একধরনের প্রেসার কাজ করে। এতে চিন্তা করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাই অযথা ব্যবহার কমিয়ে আনা ভালো।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে নিজের ব্যবহারের জন্য মোবাইল ফোন রয়েছে ৫৬ ভাগের, অর্ধেকেরও বেশি। এদের ৩১ ভাগ আবার ইন্টারনেটও ব্যবহার করে।

মার্কিনীদের অধিকাংশ বাচ্চা ১১ বছর বয়সেই নিজের স্মার্ট ফোন হাতে পায়। ৯ বছর বয়সীদের ৪৪ ভাগের নিজের ফোন রয়েছে, ১১ বছর হতে হতে তা বেড়ে ৯১ ভাগে পৌঁছায়। আর যুক্তরাজ্যে এই সংখ্যা কিছুটা কম। সেখানে ৯ থেকে ১১ বছর বাচ্চাদের ৩৭ ভাগের নিজের স্মার্ট ফোন রয়েছে, ওদের জরীপের তথ্য। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা সহজেই বোঝা যায়।

স্মার্টফোন বলা হয়ে থাকলেও এটি একটি পুরোমাত্রার কম্পিউটার। শুধু কি কম্পিউটার? সাথে ক্যামেরা, মুভি ক্যামেরা, রেকর্ডার, টিভি, রেডিও, একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত সহচর।

আজকের দিনে মানুষের পক্ষে স্মার্টফোন ছাড়া চলা সম্ভব নয়। খবরাখবর, যোগাযোগ বজায় রাখতে আপনাকে অবশ্যই স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হবে। সারা পৃথিবীকে মানুষের কাছে নিয়ে এসেছে ইন্টারনেট। আর সেটাকে পকেটে নিয়ে ব্যবহার উপযোগী করে তুলেছে স্মার্টফোন। মানুষের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। দিন দিন এর কার্যক্ষেত্র আর প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক হারে বেড়েই চলছে। বিশ্বের যে কোন প্রান্তের যে কোন বিষয়-তথ্য উপস্থিত করার অসীম ক্ষমতা রাখে স্মার্টফোনসহ সব ডিজিটাল ডিভাইস। এটি বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। প্রযুক্তির ব্যবহার করতে না পারাটা সীমাবদ্ধতা। প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্যেই উন্নত
রাষ্ট্র আর তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রের পার্থক্য।

প্রশ্ন হলো, লোকেরা স্মার্টফোনে সারাদিন কি করেন। ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগ, গেইম, ইউটিউব- গান শোনা, নাটক, মুভি, খবর দেখা- পড়া। সে তুলনায় ফোনে কথা খুবই কম বলা হয়। কেউ কেউ আবার জুয়ায় বা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।

স্ক্রিন টাইমের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক। দুই বছরের বাচ্চা এখনও কথা বলছে না। করোনা মহামারিতে এ সমস্যা বেশ ছিল। স্ক্রিনে থাকা মানে বাচ্চা শুধু দেখছে, কথা বলছে না। বাচ্চাকে অবশ্যই শোনার সাথে সেভাবে কথা তৈরি করে বলতে হবে। ঝুঁকির মধ্যে আরও রয়েছে – নরম- কোমল ভাবটা কমে যায়। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। মাথা ব্যাথা, চোখের দৃষ্টি কমে যাওয়া। তাছাড়া মারাত্মক আসক্তি- মানসিক রোগ বলছেন চিকিৎসকরা। উচ্ছ্বাস, আনন্দ, খেলা-ধূলার প্রবণতা, সামাজিকতা কমে যায়, আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। শোনা, দেখায় অভ্যস্ততা বাড়ে, পড়ার অভ্যাস কমে। সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে- ইন্টারনেট যুক্ত থাকলে বয়স অনুযায়ী দেখার অনুপযোগী অনেক কিছুই সহজে সামনে চলে আসে। এরপরও এর ভালোর দিকই বেশি। তবে ওই বয়সে ক্ষতির পরিমানই বেশি।

আসক্তি বা অপব্যবহারে মারাত্মক অসুখ হতে পারে। অধিক রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকলে হরমোন নিরসনে তারমত্য ঘটে ঘুম কমে গিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য বির্পযয় ঘটাতে পারে। অনিদ্রার অভ্যাস চোখের জল শুকিয়ে চোখে সংক্রমণ হতে পারে। গবেষণা বলছে, কিশোর- কিশোরীদের মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, যাতে আসক্তি ধরা পড়ে। তাদের মাঝে হতাশা ও উদ্বেগের কারণ ঘটায়। নীল আলো রেটিনার স্থায়ী ক্ষতি করে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। হেডফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার, উচ্চ শব্দে গান শুনলে অন্তকর্ণের ক্ষতি এবং এর প্রভাব মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক আচরণ করে।

তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ- ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন কোষের অধিক ক্ষতির ফলে মস্তিষ্কে ক্যান্সারের বড় কারণ বলছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। বিকিরণের প্রভাব শিশুদের নরম মাথার খুলিতে বেশি পড়ে। গবেষণা বলছে ২০ বছরের নীচে আসক্ত কিশোর- কিশোরীর ব্রেনক্যান্সার হওয়ার আশংকা অন্যদের তুলনায় ৫ গুণ বেশি। বিকিরণে ত্বক ও চেহারা শ্রীহীন হওয়া, পুরুষের প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি , উচ্চ রক্তচাপ, তীব্র মাথাধরাসহ হার্টের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারনে ঘাড় ও মেরুদণ্ডে বাড়তি চাপে ব্যাথা, বেশি সময় ধরে মেসেজ টাইপ করলে আঙুল ব্যাথা, ধরে রাখায় কনুই ব্যাথা, দীর্ঘক্ষণ অর্ধ-শোয়া, শোয়া বা বসায় একই ভঙ্গির কারণে শরীরের অস্থি- সন্ধিগুলোর ক্ষতির ফলে নানা ব্যাথা অসুবিধা দেখা দিতে পারে। কাজের সময় কাঁধ ও কানের মাঝে ফোন রেখে দীর্ঘসময় কথা বললেও একই ঝুঁকি রয়েছে।

গবেষণা বলছে ব্যবহারকারী পড়ুয়াদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। স্মার্ট ফোন শার্টের বুক পকেটে রাখলে হার্টের, প্যান্টের সামনের পকেটে রাখলে পুরুষের ক্ষতি আর পেছনের পকেটে রাখলে পায়ে ব্যাথার ঝুঁকি বাড়ে। রাতে বালিশের কাছে রেখে ঘুমানো আরও মারাত্মক ক্ষতির কারণ। গাড়ি-মোটরসাইকেল চালাতে, রাস্তা পার হতে, রেললাইনে মোবাইল ব্যবহার- দুর্ঘটনার বড় কারণ।

নিউইয়র্ক পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন উত্তর- পশ্চিম ম্যাসাচুসেটসের এক উচ্চ বিদ্যালয়ে কোভিড মহামারির পর ক্লাস শুরু হলে দেখা যায়, পড়ুয়ারা একে অপরের সাথে কথা বলার অভ্যাস ভুলে গেছে। অন্যদের সাথে থাকার বা জায়গা ভাগ করার অভ্যাস চলে গেছে। আর তাই ১১৪ একর ক্যাম্পাসে আইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহার নিষেধ করা হয়। কিছু ছাত্র ঘোষণা শুনে প্রথমে ভয় পায়। তারা কল্পনাও করতে পারেনি ডিভাইস ছাড়া চলে কেমন করে। অথচ পরিবর্তনের সাথে তারা ভাল মানিয়ে নিয়েছে। পরিবর্তনটি প্রয়োজন ছিল। শিক্ষার্থীরা উন্নতি করেছে। তবে তাদের একটি হালকা ফোন দেয়া হয়েছে, শুধু ফোন করা আর ম্যাসেজ পাঠাতে। শিক্ষার্থীরা স্কুল শেষে ডেস্কটপে সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার করছে। এখন তারা সৃজনশীল ভাবে নিজেদের প্রকাশ করছে, একে অপরকে জানার ও নিজেদেরকে জানার চেষ্টা করছে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ- উন্নতি হয়েছে।

বর্তমানে বেশিরভাগ তরুণ- তরুণী অনলাইন গেইমসে আসক্ত। তারা দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে ভার্চুয়াল জগতে। শিশুরা গেইমসে আসক্ত হওয়ায় নানা রকম ডিজঅর্ডার- অসুখ দেখা দিয়েছে। আবার নিজের অজান্তেই তারা সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা, নিয়মশৃঙ্খলা ও নেতৃত্বগুণসহ মানবিক গুণাবলি হারিয়ে সামাজিক ও নৈতিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পারিবারিক – সমাজ বিচ্ছিন্ন একটা স্বতন্ত্র নিজের জগত-জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদেরও ভাববার সময় হয়েছে। করণীয় ঠিক করা দরকার। অবস্থা দিন দিনই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির দিকে এগুচ্ছে। ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক পরিনতির নানা ঘটনা ও চিত্র উঠে আসছে প্রায়ই। তাই স্মার্টফোন- ভার্চুয়াল বেশি সময় কাটানোর আসক্তি রোধে রাতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত রাখা যেতে পারে।

পরিচিতঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *