November 21, 2024
সংবাদ শেয়ার করুন

সাহস ভীষণ সুন্দর। সাহস সৃষ্টির পথ দেখায়। সাহসই মেধার পরিস্ফুটন ঘটায়। একসময় সাহসেরা ভীড় করতো বায়তুল মোকাররম, পল্টন ময়দান, মতিঝিলে। এখন শাহবাগে। শাহবাগ সাহসী হলে ভূমিকম্প হয়। ধ্বসিয়ে দেয় অন্যায়ের পাটাতন। শাহবাগ ঘাতকদের সাথে আপোষ হতে দেয়নি। ঘাতকের হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে জন্ম শাহবাগের। ঘাতকের রাজনীতিতে বিশ্বাসীরা তাকে ‘শাহবাগী’ বলে গালি সৃষ্টি করেছে। এখন অবশ্য এই খেকশিয়ালেরা সুরসুরির মজা পায়। সত্য এমনই। আপেক্ষিক, চিরন্তন নয়। শরৎচন্দ্রের ভাষায়, “এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবটাই পরিপূর্ণ সত্য। মিথ্যার অস্তিত্ব যদি কোথাও থাকে, তবে সে মনুষ্যের মন ছাড়া আর কোথাও না”। শাহবাগ সত্যের পক্ষে দাঁড়ায়। মানুষের নিজের বিভক্ত অবস্থানের কারণে সে শত্রুমিত্রে গণ্য হয়। এজন্য শাহবাগ আমাদের গর্ব হয়ে ওঠছে।

যদিও এবারের শাহবাগ এখনো আন্দোলন হয়ে ওঠেনি। একটা ভ্রুণের অস্তিত্ব ঘোষিত হয়েছে। পরিপূর্ণ শিশু হয়ে জন্মাবে কিনা সেটা সময় বলবে। কারণ এই আন্দোলন কেবলমাত্র সরকারি কর্মপ্রাপ্তির দাবীতে। রাজনৈতিক অধিকারের কিছুই এখানে নেই। একটা সফট কর্মসূচির বড়ো হয়ে ওঠার সুযোগ কম। যদিও মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গটি নিয়ে টানাটানির একটা বিকৃত বিভাজন আছে। এখানেই ঘাতকদের সুরসুরির আনন্দ।

এবারের আন্দোলন আগের চেয়ে ভিন্ন এবং ব্যাপ্ত। তারা আলাদা করে মুক্তিযোদ্ধা, জেলা বা নারী কোটা নিয়ে দাবি তুলেনি। তারা সরকারি সকল চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাতিল চায়। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে ৩০ থেকে ৫ শতাংশে সমন্বয়ের প্রস্তাব তাদের। তার মানে আন্দোলনকারীরা মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে উপেক্ষা করেনি। কিন্তু অসভ্য দলীয় অন্ধ মূর্খ চেতনা: একটি সামাজিক আন্দোলনকে বিকৃত করে উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার অপচেষ্টা করছে। আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক পক্ষ বিষয়টিকে ঘোলাটে রেখে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা আন্দোলনকারীদের প্রতিপক্ষ ভাবছে।
একটি পরিচ্ছন্ন ছাত্র আন্দোলনকে বিভাজিত করছে বিকৃত রাজনৈতিক মানসিকতা। এখানেই মানুষ সত্যকে তার মতো করে বর্ণনা করে মিথ্যায় বদলে দিতে চাচ্ছে।

আমি কেন কোটা বাতিলের পক্ষে? কারণ কোটা মেধাকে ধ্বংস করে। সবাইকেই যোগ্যতা দিয়ে উঠে আসা উচিত। তবে বিশেষ বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কোটা রাখা যেতে পারে। আর মুক্তিযোদ্ধার নাতি নাতনির সুবিধা বিশ্রী ঠেকে। মেধার সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ জাতিকেই ধ্বংস করে দেয়। এই কোটা পাকিস্তানের সৃষ্টিকেই অতলে নিয়ে গেছে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানে কোটা ব্যবস্থা চালু হয়। তখন ৪টি প্রভিন্স ও একটি ক্যাটাগরিতে কোটা বিভাজন করা হয়। ১.পূর্ববঙ্গ, ২.পশ্চিম পাঞ্জাব, ৩.সিন্ধু, বেলুচিস্তান, এনডাব্লিউএফপি ও খায়েরপুর, ৪. করাচি এবং ৫. সম্ভাব্য অভিবাসী। এই ৫ ক্যাটাগরির জন্য বরাদ্দ ছিল মোট চাকরির ৯২.৫ শতাংশ। আর মেধার জন্য ছিলো মাত্র ৭.৫ শতাংশ। পাকিস্তান মেধাকে চরম অবজ্ঞা করেছে।

স্বাধীনতার পরও আমরা সাম্য সামাজিক সুবিচারের পথে হাঁটিনি। ১৯৭২ সালে মেধার কোটা পাকিস্তানের ৭.৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করা হয়। বাকি ৮০ শতাংশ দেয়া হতো কোটায়। ১৯৭৬ সালে মেধা কোটা করা হয় ৪০ শতাংশ। ১৯৮৫ সালে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৫ মেধায় এবং বাকি ৫৫ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে চাকরি দেয়া হয়। পরবর্তীতে প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৫৬ শতাংশ চাকরি কোটার ভিত্তিতে দেয়া হয়। এই প্রথা চলছে গত ৩৯ বছর ধরে। অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ (মুক্তিযোদ্ধা ৩০, নারী ১০, জেলা ১০, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী) কোটায় এবং ৪৪ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাচ্ছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রে সন্তানের জায়গায় নাতি নাতনিদের যুক্ত করলে বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পায়।

২০১৮ সালে ভিপি নূরের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয় সেটা ছিল কেবল ১ম ও ২য় গ্রেডের চাকরির ক্ষেত্রে। যা সরকার তখন বাতিল করে। সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরির ২০ টি গ্রেডের মধ্যে সেই আন্দোলনে ৯ম থেকে ১৩ তম গ্রেডে চাকরির ক্ষেত্রে কোটা বাতিল হয়। যা গত ৫ জুন হাইকোর্ট পুনর্বহাল করে। সুপ্রিম কোর্ট এটি স্থগিত করায় শুধুমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নিয়োগে কোটা স্থগিত হলো। অন্যত্র সবই বহাল রয়ে গেছে।

কিন্তু এবারের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারি চাকরির সকল নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান চেয়েছে। এজন্যই এর ব্যাপ্তি বেশি। এই আন্দোলন সুপ্রিম কোর্টের আদেশের মধ্যে পরে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *