১৮ জুলাইয়ের কুমিল্লা কোটবাড়ির উত্তাল দুপুর: একটি প্রজন্মের চোখে যুদ্ধ

রাকিব হোসেন।।
১৮ জুলাই ২০২৪। দিনটি কোনো সাধারণ দিন ছিল না। ইতিহাসের পাতায় যোগ হওয়া এক বিভীষিকাময় বীরত্বগাথা। মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি এ প্রজন্ম, দেখেনি বদর-উহুদ-খন্দকের যুদ্ধও। কিন্তু যারা চোখে দেখেছে ১৮ জুলাইয়ের সেই দুপুর, তাদের কাছে দিনটি এক অন্যরকম সম্মুখ সমর।
দৃশ্যপটে দুই পক্ষ—একদিকে ছাত্র-জনতা, অন্যদিকে সাঁজোয়া যান আর আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্থান: কুমিল্লার কোটবাড়ি। সময়: দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথে।
চৌদ্দগ্রামে সকাল থেকেই শুরু হয় ছাত্রদের মিছিল। তখনও কেউ ভাবেনি, দুপুরের আগুন কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে। সহকর্মী সাংবাদিক সজীব মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ, তারপর একেকজন রওনা দিল চৌদ্দগ্রাম, লালমাই, পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড হয়ে কোটবাড়ির দিকে।
রাস্তায় যানবাহনের সংকট। অটোই ভরসা। সঙ্গে যাত্রা করা সঙ্গীদের কেউ জানতো না, সামনের মুহূর্তগুলো তাদের জীবনের স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে উঠবে।
দুপুর ১২:৫০। আন্দোলনস্থলে পৌঁছেই শুরু হয় মুখোমুখি অবস্থান। পুলিশ, এপিবিএন, বিজিবি, র্যাব সহ অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছাত্ররা স্লোগানে মুখর। আচমকা উত্তেজনার বিস্ফোরণ। একটি বোতল ছুড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-পালটা আক্রমণ।
টিয়ার গ্যাসে অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ। চোখ জ্বালা করে, মুখ পুড়ে যায়। আশেপাশে আহতের হাহাকার। এক ভাই গুলিবিদ্ধ ছাত্রকে কোলে তুলে দৌড়াচ্ছেন—ছবিটি যেন শহীদদের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।
“পালাও”—এমন আহ্বান ছিল না কারো মুখে। যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা ছিল সাধারন ছাত্র, মারামারি না-করা, নিষ্পাপ কিছু তরুণ। তবু তারা দাঁড়িয়ে ছিল গুলির মুখে। সাঁজোয়া যান থেকে ছোড়া গুলির বিপরীতে তারা প্রতিরোধ গড়েছিল বুক দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল তিনটার দিকে একটি সাঁজোয়া যান আন্দোলনকারীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়। সেখানে আগুন জ্বলে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। জোহরের আজানের আগ মুহূর্তে শুরু হওয়া মুখোমুখি লড়াই গড়ায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণায়।
এই লড়াইয়ে শুধু ছাত্ররাই ছিল না। আশপাশের বাড়ির মা-বোনেরা তাড়িত হয়ে আসেন আহতদের পাশে। কেউ পানি দেন, কেউ শরবত, কেউ আঁচল ছিঁড়ে ক্ষত বাঁধেন। এমন ভালোবাসা, এমন মানবিকতা কেবল আন্দোলন নয়—একটি জাতির মানবিক পুনর্জাগরণের প্রতীক হয়ে ওঠে।
সন্ধ্যায় ঘোষণা আসে, কর্মসূচি আপাতত স্থগিত। আহত, ক্লান্ত, ধূলিধূসরিত আন্দোলনকারীরা একে একে বিদায় নেয়। পরিচিত মুখগুলোর সঙ্গে দেখা হয় আবার—পলাশ, মিনহাজ, রোহান, সৈকত, রিয়াদ, সিয়াম, আজিম, কাইয়ুম—সবাই জীবনের আরেক নতুন উপলব্ধি নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটেন। কেউ ৫০ মিনিট হেঁটে, কেউ রিকশায়, কেউবা অটোতে করে জাঙ্গালিয়া স্ট্যান্ড হয়ে বাড়ি ফেরেন।
১৮ জুলাইয়ের সেই বিকেল কেবল স্মৃতি নয়, ইতিহাস। এখানে রক্ত ঝরেছে—ভয়ের নয়, সাহসের। অপমানের নয়, অধিকার আদায়ের। এই ইতিহাস বলে, যারা বুক পেতে দেয়, তারাই একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। এই ইতিহাস বলে, সংগ্রামই জাতির আত্মমর্যাদার রূপরেখা।
যুদ্ধ হয় কেবল বন্দুক দিয়ে নয়। কখনো যুদ্ধ হয় আদর্শ নিয়ে, অধিকার নিয়ে, কিংবা ন্যায়ের দাবি নিয়ে। ১৮ জুলাই ছিল তেমনই এক যুদ্ধে গর্জে ওঠা দিন। সেই দিন, যেদিন ছাত্ররা দেখিয়ে দিয়েছিল—তাদের হৃদয়ে এখনো জ্বলছে পরিবর্তনের আগুন।